যেভাবে চালের দাম কমানো যায়

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: একটা খুব সাধারণ প্রশ্ন সবসময় উচ্চারিত হচ্ছে- ভরা মৌসুমে চালের দাম বেশি কেন? কারণ নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেন। অর্থনীতির তত্ত্ব খাটিয়ে বলেন, বাজারের সরবরাহ ঠিক থাকলে দাম কমবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মাসখানেক আগে বাজারে আমন ধান আসায় এখন চালের দাম কমার কথা। কিন্তু বাড়ছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা

বাজার ব্যবস্থাপনায় এমন কিছু একটা আছে যার কারণে অর্থনীতির সেই চাহিদা আর যোগান তত্ত্ব কাজ করছে না। অসময়ে চালের দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য চালকল মালিকদের দুষছেন অনেকেই। খাদ্যমন্ত্রীও কয়েকদিন আগে বলেছেন মিল মালিকরা প্রতিযোগিতা করে ধান কেনায় চালের দাম বেড়েছে। বরাবরের মতোই চালকল মালিকরা বাজারে ধানের সরবরাহ কমে যাওয়া এবং দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ি করছেন।

গত ১৭ জানুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয়ে এক মতবিনিময় সভায় উপস্থিত দেশের চালকল মালিক, আড়তদার, করপোরেট ও চালের পাইকারি ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্য করে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার কিছু কড়া কথা বলেছেন। বলেছেন, এখন আমনের ভরা মৌসুম। এ সময়ে চালের দাম বাড়বে এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। মিলগেটে ২ টাকা দাম বাড়লে পাইকারি বাজারে ৬ টাকা কেন বাড়বে? অবৈধ মজুতকারী কিংবা অহেতুক দাম বাড়িয়ে দেওয়া ব্যবসায়ী কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সবাইকে জবাবদিহি করতে হবে।

নির্বাচনের পর হঠাৎ করে যেভাবে চালের দাম বেড়েছে, তা স্বাভাবিক বলে মনে করছেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। সম্প্রতি গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের জরুরি সভার আগে প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের সামনে বলেন, ‘নির্বাচনে এদেশের মানুষ যখন অংশগ্রহণ করেছে, এখন অযথা একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সবচেয়ে অবাক লাগে, কথা নাই বার্তা নাই হঠাৎ করে চালের দাম বেড়ে গেল, জিনিসের দাম বেড়ে গেল! তিনি বলেছেন, দুরভিসন্ধি নিয়ে কোনো পণ্য মজুদ করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’

অনেক জায়গায় সরকারি কর্তৃপক্ষ নামছে, বাজার তদারকি করছে। এর কিছু ফলও তাৎক্ষণিকভাবে আসছে। চালের দামে ঊর্ধ্বগতি এবং প্রশাসনের চাপে সামান্য নিম্নগতি থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী বাজারে চালের দাম নির্ধারিত হচ্ছে না।

দেশের চালের দাম চালকল মালিক তথা চাল ব্যবসায়ীদের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। মূলত চালকল মালিকরা কীভাবে চালের বাজার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন সেটা বুঝতে পারাই মনে হয় বড় কাজ দিবে দাম কমানোতে। খাদ্যমন্ত্রীর কথা যুক্তি আছে। কারণ আমরা বাজার থেকে যে তথ্য পাচ্ছি তাতে দেখা যায়, বরাবরই চালকল মালিক ও বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতা করে বাড়তি দামে ধান কিনতে থাকে। এতে চালের দাম বাড়তে থাকে। প্রতিযোগিতা করে ধান কেনার এই পদ্ধতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় সেই পথ দেখতে হবে সরকারকে।

আরেকটি কারণ হলো চালকল মালিকরা বিপুল পরিমাণে কেনা ধান চালে রূপান্তর করেন এবং নিজেদের মধ্যে একটা বোঝাপড়ার মাধ্যমে অপর্যাপ্ত পরিমাণে চাল বাজারে ছেড়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন। এর মাধ্যমে তারা বেশি লাভ করেন। এটাই সিন্ডিকেশন বা কারসাজি। তাহলে এর সমাধান কোথায়? প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তার বাস্তবায়ন দৃশ্যমান হলে একটা বাস্তব প্রভাব পড়তে পারে বাজারে। এদের চিহ্নিত করা কঠিন কাজ নয়। দু’একজনকে সাজা দিলে বাকিরা সাবধান হতে পারে।

আরেকটা কাজ হলো একচেটিয়াত্ব বন্ধ করার উপায় বের করা। আমাদের অভ্যন্তরীণ চাল সংগ্রহ পদ্ধতি পুরোটাই চালকল মালিকদের ওপর নির্ভরশীল। সরকার নিজেই তা করেছে। চলমান নীতিমালায় অভ্যন্তরীণভাবে চাল সংগ্রহের জন্য চালকল মালিকরা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উৎস নেই।

সরকার বলছে বাজার অর্থনীতির কথা, বাস্তবে তা মানছে না। ২০০৬ সালের জাতীয় খাদ্যনীতিতে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে চাল ও অন্যান্য খাদ্যশস্য কেনার নির্দেশ ছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। চালকল মালিকরা এ সুযোগের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করছেন।

সরেকার নিজে যে চাষীদের কাছ থেকে ধান কেনে সেটা সামান্য পরিমাণ। ধান কাটা-মাড়াইয়ের মৌসুমে চালকল মালিকরা একত্রিত হয়ে স্বল্প দামে প্রচুর পরিমাণে ধান কিনে নেন। নিয়ে মজুত করেন। তারা এ ধান থেকে চাল উৎপাদন করে সরকারকে চাল সরবরাহ করেন চুক্তি মোতাবেক। অবশিষ্ট চালের বড় অংশটি চড়া দামে বাজারে বিক্রি করেন কারসাজি করে।

সরকার আমদানি করে একটা ভারসাম্য আনতে পারে। তবে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না ডলার সংকটের কারণে। তাই বাজারে নজর দিতে হবে। চালকল মালিক ও বড় কর্পোরেট কোম্পানিগুলো সিন্ডিকেট করে চালের দাম যেন নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে সে বিষয়টিতেই দৃষ্টি দিতে হবে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।